তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না
কার্তিকের অপরাহ্ন। কিন্তু রোদের তীব্র তাপ। মনে হচ্ছিল, বৈশাখের কোনো রুদ্র দিনে ঘেমেনেয়ে আমরা পথ চলছি। এমন দুঃসহ দিনে হঠাৎ পথের বাঁকে পেয়ে গেলাম জগৎচন্দ্র মহাজনের পান্থশালা। ১৯২৭ সালে সেকালের খ্যাতিমান ভূস্বামী জগৎ চৌধুরী দূরের পথের যাত্রীদের কল্যাণের কথা ভেবে পান্থশালাটি তৈরি করেছিলেন।
সে সময় পটিয়া থেকে বোয়ালখালী যাওয়ার এ পথ এখনকার মতো পিচঢালাই ছিল না। ছিল সংকীর্ণ একটি মেঠো পথ। এ পথেই দক্ষিণভূর্ষির ডেঙ্গাপাড়ায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-বাদলের দিনে পথিকের আশ্রয়ের জন্য এ পান্থশালা। সম্প্রতি এ সড়কের নামকরণ হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দেওয়া বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নামে। এ পান্থশালার কাছেই প্রীতিলতার গ্রাম ধলঘাট। ধলঘাটের ভূমিতে জন্ম নিয়েছেন অনেক বিপ্লবী ও কীর্তিমান মানুষ।
সে সময় পটিয়ার দক্ষিণভূর্ষি, ধলঘাট, গৈরলাসহ ব্রিটিশ শাসনবিরোধী বিপ্লবীরা এখানে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। পান্থশালার এ পথ দিয়েই তাঁরা আসা-যাওয়া করতেন। কথিত আছে, মাস্টারদা সূর্য সেনকে গৈরলা থেকে আটক করার পর এ পথ দিয়েই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত এ রকম একটি ঐতিহ্যময় স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে ফিরে গেলাম সেই অগ্নিময় দিনগুলোতে। চারদিকের নিবিড় গাছপালা, লাগোয়া শানবাঁধানো ঘাট, স্বচ্ছ পানির বিশাল পুকুর সেদিন অপরাহ্নে আমাদের মনকে আর্দ্র করে তুলেছিল। পাশাপাশি ব্যথিতও হয়েছে মন। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর এ অসাধারণ শিল্পকর্ম এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। এর ভেতরের অবকাঠামো বয়সের ভারে ন্যুব্জ। উন্নয়নের কারণে পাশের সড়কটির উচ্চতা বেড়েছে। ফলে প্রাচীন প্রত্নসম্পদটি নিচে পড়ে গেছে। এর ভেতরের বসার আসনগুলোতে ফাটল ধরেছে। জানালাগুলোর দরজা নেই। বাইরের দিকে ওপরে ওঠার পাকা সিঁড়ির হাতল চলে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই ঘর। সিলিংয়ে কাঠের ক্ষয়িষ্ণু বিমগুলো এখনো আছে, তবে দেখলেই বোঝা যায়, যেকোনো সময় ধসে পড়বে। টিনের ছাউনিতেও জং ধরেছে। বার্ধক্যে আক্রান্ত ঐতিহ্যের স্থাপনাটির বড় শুশ্রূষা প্রয়োজন। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্থাপনাটিকে পুরাকীর্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে হবে। এমন দাবি শুধু পটিয়ার মানুষের নয়, পুরো চট্টগ্রামবাসীর।
পান্থশালায় বিশ্রামের পর প্রীতিলতা সড়ক ধরে গেলাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু দস্তিদার, সাবিত্রী দেবী, পুলিন দে, দীনেশ দাশগুপ্ত, ব্রজেন সেনসহ বহু বিপ্লবীর স্মৃতিধন্য রত্নগর্ভা গ্রাম ধলঘাটে। এখানেই ১৯১১ সালে প্রীতিলতার জন্ম। তাঁর দুরন্ত শৈশব কেটেছে এখানেই। তবে পড়ালেখা, চাকরি, নানা কর্মকাণ্ডের কারণে গ্রামে বেশি দিন থাকতে পারেননি। অবশ্য মৃত্যুর তিন মাস আগে ১৯৩২ সালের ১৩ জুন গ্রামে এসেছিলেন। সে সময়ই মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। যেদিন তিনি নিজের গ্রামে এসেছিলেন, সেদিনই বিপ্লবীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল।
ধলঘাটের দস্তিদারপাড়ায় প্রীতিলতার ভিটেতে আমরা যখন পৌঁছাই, তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রাস্তার পাশে ভিটার প্রবেশপথে একটি তোরণ।
বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৯৭১ সালে মৃত্যুর আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ও প্রীতিলতার স্মারক হিসেবে এখানে একটি স্তম্ভ তৈরি করেন। সেই স্তম্ভের পেছনে ঘন ঝোপঝাড় আর সংকীর্ণ আল ধরে আমরা যেখানে গেলাম, সেখানে নির্জন শান্ত পুকুরের পাড়ে প্রাচীন গাছপালার ছায়ায় চুপচাপ শুয়ে আছে যেন প্রীতিলতার জন্মভিটাটি। কোনো ঘরবাড়ি নেই, মানুষের কোলাহলবর্জিত এ জায়গায় মানুষের পদচিহ্ন পড়ে না। কোথাও কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। প্রীতিলতা এ দেশের ইতিহাসে একটি অহংকারের নাম, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রতীক। তাঁর ভিটেবাড়িতেই এখন ঘুঘু চরছে। এই শূন্যতা আমাদের ঐতিহ্যবিমুখ মনের দৈন্যকেই শুধু স্পষ্ট করে তুলেছে।
এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রীতিলতা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য জানালেন, জলাশয়, জমিসহ প্রীতিলতার পূর্বপুরুষের ৬০ শতকের মতো জায়গা আছে ওখানে। কিন্তু জায়গাটি এখন অর্পিত সম্পত্তির (ভিপি) অন্তর্ভুক্ত। কিছু করতে হলে প্রথমে এ ভূমিকে ভিপি শ্রেণি থেকে মুক্ত করতে হবে।
প্রীতিলতার শূন্য ভিটা থেকে যে হাহাকার নিয়ে এসেছি, তার ওপর কিছুটা শান্তির প্রলেপ পড়েছে ওখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এসে। ওখানে সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্ট সাংস্কৃতিক ভবন। পাবলিক, প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রজেক্টের অধীন জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ভবনটি নির্মিত হয়। এই সুন্দর ও আধুনিক ভবনটির সামনে প্রীতিলতার একটি আবক্ষ ভাস্কর্য দেখলাম। এখানে শিশু–কিশোরেরা গান, আবৃত্তি, নাচ ইত্যাদি শিখছে। এটি সংস্কৃতিচর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে পটিয়ায়।
শিশুদের কোলাহলে প্রাণটা প্রশান্ত হলেও মনের কোনায় কোথাও যেন একখণ্ড মেঘ জমে আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে রেখেছে। প্রীতিলতার জন্ম গ্রামে হলেও চট্টগ্রাম শহরের ডা. খাস্তগীর স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এই শহরের অপর্ণাচরণ স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। চাকরিহারা দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানটি চাইলে বড় চাকরি করতে পারতেন। প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন তাঁকে বিপ্লবের পথে নিয়ে এসেছে।
দক্ষিণভূর্ষির ডেঙ্গাপাড়ায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-বাদলের দিনে পথিকের আশ্রয়ের জন্য এ পান্থশালা।
দক্ষিণভূর্ষির ডেঙ্গাপাড়ায় রোদ, বৃষ্টি, ঝড়-বাদলের দিনে পথিকের আশ্রয়ের জন্য এ পান্থশালা।ছবি: প্রথম আলো
১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলীতে ইংরেজদের প্রমোদকেন্দ্র ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। ইংরেজদের ওপর আক্রমণের পর নিজে আহত হলে সায়ানাইড মুখে নিয়ে আত্মাহুতি দেন। সেই ঘটনার পর ৯০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। যে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রীতিলতারা, সেই দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর আগে। কিন্তু প্রীতিলতার স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা তেমন কিছুই করতে পারিনি।
কদিন আগে এক রোদেলা দুপুরে কলকাতা থেকে আসা লেখক পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ও রতনতনু ঘাটীর অনুরোধে তাঁদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম ইউরোপিয়ান ক্লাব। দেখলাম, সেটিও শূন্যতায় হাহাকার করছে। খালি ঘরটি পড়ে আছে। সেখানে যেন প্রীতিলতার আত্মার ধ্বনি শুনতে পেলাম। ক্লাবটিরও জরাজীর্ণ অবস্থা। ভেতরে কাঠের মেঝে এবং সিলিংয়ে কাঠের বিমগুলো নড়বড়ে। এ ভবনে আগে বাংলাদেশ রেলওয়ের দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড চলত।
এ বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ঘোষণা দিয়েছে, ইউরোপিয়ান ক্লাবকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হবে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি। ব্রিটিশ শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো চট্টগ্রামে সংঘটিত বৈপ্লবিক ঘটনার স্মরণে এ শহরে তেমন কিছুই হয়নি। এই গ্লানি আমাদের লজ্জা দেয়। ইউরোপিয়ান ক্লাবের অদূরে শিরীষগাছের ছায়ায় প্রায় এক দশক আগে প্রীতিলতার একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। ধুলায় ধূসর সেই ভাস্কর্যের চারপাশে কারা যেন কিছু গানের কথা বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে—তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক।
Comments